অবরোহ যুক্তিবিজ্ঞানের একটি বিশেষ আলোচ্য বিষয় হল বচন।যুক্তিবিজ্ঞানকে জানতে হলে, বচনকে জানার সাথে সম্বন্ধ অনুসারে বচন কয় প্রকার ও কি কি (Types of Proposition According to the Relation), এসবের বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন।
বাক্য গঠনের জন্য দুই বা ততোধিক ধারণাকে পারস্পরিক তুলনার মাধ্যমে সংযুক্ত করতে হয় এবং বচনের ক্ষেত্রেও এরূপ তুলনা আবশ্যক।এই বিষয়টি প্রাথমিকভাবে ঘটে মানসিক স্তরে।এই মানসিক স্তরের প্রক্রিয়াটি কে বলে অবধারণ। এর পরবর্তী পর্যায়ে অবধারণ ভাষায় প্রকাশিত হয় এবং যুক্তিবিজ্ঞানের নির্দিষ্ট আকার অনুসারে প্রকাশিত হয়। তখন সেই বাক্যটিকে বলে বচন বা Proposition । বচনের দ্বারা যুক্তির আকার কে গঠন করা হয়। তাই সম্বন্ধ অনুসারে বচন কয় প্রকার ও কি কি ইত্যাদি যুক্তিবিদ্যার আলোচ্য বিষয়।
সম্বন্ধ অনুসারে বচন কয় প্রকার ও কি কি | Types of Proposition According to the Relation
বচনে দুটি পদের মধ্যে সম্বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এই সম্বন্ধ শর্ত নিরপেক্ষ বা শর্তসাপেক্ষ হতে পারে। কাজেই সম্বন্ধ অনুসারে বচন দুই প্রকার- নিরপেক্ষ বচন এবং সাপেক্ষ বচন। সাপেক্ষ বচন আবার দুই প্রকার – প্রাকল্পিক বচন ও বৈকল্পিক বচন।সাপেক্ষ বচনকে যৌগিক বচন ও বলা হয়। প্রত্যেকটির দৃষ্টান্ত সহ আলোচনা করা হল-
নিরপেক্ষ বচন
যে বচনে দুটি পদের মধ্যে সম্বন্ধ কোন রকম শর্তের উপর নির্ভর না করে গঠিত হয় তাকে নিরপেক্ষ বচন বলে।
উদাহরণঃ ‘কাক হয় কালো‘।নিরপেক্ষ বচনে দুটি পদ থাকে। একটি উদ্দেশ্য পদ, অপরটি বিধেয় পদ। এই বচনে বিধেয় পদ বিনা শর্তে বা শর্ত নিরপেক্ষভাবে উদ্দেশ্য পদ সম্পর্কে কিছু স্বীকার বা অস্বীকার করে।এখানে বিধেয় পদ ‘কালো’ বিনাশর্তে উদ্দেশ্য পদ ‘কাক’ সম্বন্ধে কিছু স্বীকার করেছে।
অনুরুপভাবে ‘কোন পাখি নয় মানুষ‘, এই বচনে বিধেয় পদ ‘মানুষ’ বিনাশর্তে উদ্দেশ্য পদ ‘পাখি’ সম্বন্ধে কিছু অস্বীকার করেছে।
নিরপেক্ষ বচন চারটি অংশে বিভক্ত। এই চারটি অংশ হল –
i) মানক চিহ্ন
ii) উদ্দেশ্য পদ
iii) বিধেয় পদ
iv) সংযোজক
দৃষ্টান্তস্বরূপ- ‘সকল মানুষ হয় মরণশীল’। এক্ষেত্রে ‘সকল‘ হল মানক চিহ্ন, ‘মানুষ‘ হল উদ্দেশ্য পদ, ‘হয়‘ হল সংযোজক এবং ‘মরণশীল‘ হল বিধেয় পদ।
মানক বা পরিমাপক বচনের পরিমাণ নির্দেশ করে। প্রতিটি নিরপেক্ষ বচনের উদ্দেশ্যের আগে ‘সকল’, ‘কোন কোন’, এই শব্দগুলির যেকোনো একটি মানক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া প্রতিটি নিরপেক্ষ বচনে উদ্দেশ্য ও বিধেয়র মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনকারী যে চিহ্ন থাকে তাকে সংযোজক বলে। বচনে যে পদটি সম্বন্ধে কিছু স্বীকার বা অস্বীকার করা হয় তাকে বলে উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য সম্পর্কে যা কিছু স্বীকৃত বা অস্বীকৃত হয় তাকে বলে বিধেয়। যুক্তিবিজ্ঞানে উদ্দেশ্য এবং বিধেয় পদ হিসেবে গণ্য হলেও সংযোজক কিন্তু কোন পদ নয়। এটি কেবল মাত্র একটি শব্দ। নিরপেক্ষ বচনের আকারটি নিম্নরুপ-
মানক ……….উদ্দেশ্য …. সংযোজক…..বিধেয়
সকল S হয় P
কোনো S নয় P
কোনো কোনো S হয় P
কোনো কোনো S নয় P
উদ্দেশ্য ও বিধেয়র মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপন করে সংযোজক এই সম্বন্ধও স্বীকৃতির বা অস্বীকৃতির হতে পারে। সংযোজক ‘হয়‘ সদর্থক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ‘নয়‘ সংযোজকটি নঞর্থক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
সাপেক্ষ বচন
যে বচনে দুটি বিষয়ের সম্বন্ধ কোন শর্তের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে তাকে সাপেক্ষ বচন বলে।
এরূপ বচনের উদ্দেশ্য ও বিধেয়র সম্বন্ধটি একটি শর্তের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। কোন শর্ত ছাড়া উদ্দেশ্য ও বিধেয়র সম্বন্ধটিকে তাই এখানে কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না।।সাপেক্ষ বা শর্তাধীন বচনে কোন শর্তকে স্পষ্টভাবে বা অস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। এরূপ বচন হয় প্রাকল্পিক, না হয় বৈকল্পিক হবে। সাপেক্ষে বচন তাই দুই প্রকার – ক) প্রাকল্পিক বচন ও খ) বৈকল্পিক বচন।
সম্বন্ধ অনুসারে বচনের প্রকারভেদ (Types of Proposition) আলোচণা করতে গিয়ে আমরা সাপেক্ষে বচনের দুটি প্রকার বিস্তারিত জানব –
যে সাপেক্ষ বচনে অঙ্গবাক্য দুটির মধ্যে শর্ত ‘যদি-তবে’ শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হয়, সেই সাপেক্ষ বচনকে প্রাকল্পিক বচন বলে।উদাহরণঃ ‘যদি মেঘ করে তবে বৃষ্টি হয়’।
এই প্রাকল্পিক বচনটিতে ‘যদি’ এবং ‘তবে’ এই শর্ত দুটির বাস্তবায়ন হয়েছে। উদাহরণে বলা হয়েছে, যদি মেঘ করে তবেই বৃষ্টি হয়। অর্থাৎ মেঘ করলেই বৃষ্টি হবে, – এটি কেবল শর্ত সাপেক্ষ। এই বচনের ক্ষেত্রে কেবল পূর্বগ সত্য, অনু্গ মিথ্যা হলেই বচনটি মিথ্যা হয়। অন্য সব সত্যমূল্যের ক্ষেত্রে বচনটি সত্য হয়ে থাকে। প্রাকল্পিক বচনের আকারটি হল- যদি p তবে q ।
যে সাপেক্ষ বচনের অঙ্গ বাক্য দুটির মধ্যে শর্ত ‘হয়-অথবা’ শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হয় তাকে বিকল্পিক বচন বলে।
উদাহরণঃ ‘হয় আমি যাব অথবা তুমি যাবে’।
এই সাপেক্ষ বচনটিতে ‘হয়’ এবং ‘অথবা’ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। উক্তিটিতে বলা হয়েছে ‘হয় আমি যাব’ ‘অথবা তুমি যাবে’। এক্ষেত্রে কোন একজনই যাবে, এমন একটি শর্তসাপেক্ষ উক্তি প্রতিফলিত হচ্ছে। বৈকল্পিক বচনের আকারটি হল- হয় p অথবা q । এরূপ বচনের ক্ষেত্রে কেবল সবগুলি বিকল্প মিথ্যা হলেই বৈকল্পিক বচনটি মিথ্যা হয়। আর যেকোনো একটি বিকল্প সত্য হলেই বচনটি সত্য হয়।
উপসংহার
পরিশেষে, সম্বন্ধ অনুসারে বচন কয় প্রকার(Types of Proposition) ও কি কি এবং এর প্রত্যেকটি দৃষ্টান্ত থেকে আমরা সংক্ষেপে এমন বলতে পারি যে, সম্বন্ধ অনুসারে বচন দুই প্রকার- নিরপেক্ষ ও সাপেক্ষ। সাপেক্ষ বচন আবার দুই প্রকার- প্রাকল্পিক ও বৈকল্পিক। সুতরাং কেবল বচন নয়, তার প্রকারভেদ এবং আরো অন্যান্য বিষয় আলোচনা ছাড়া যুক্তিবিজ্ঞান সম্পর্কে পরিপূর্ণতা সম্ভব নয়।
তথ্যসূত্র (References)
- C.R Morris : Locke, Berkeley and Hume , Greenwood Press, 1980
- A Critical History of Modern Philosophy: Y.H. Masih
- Falckenberg : History of Modern Philosophy, Project Gutenberg, 1920
- History of Western Philosophy: B. Russell
- The Rationalists: J. Cottingham
- The Works of Descartes: Haldane & Ross (eds.)
- Descartes: A. Kenny
- Internet Sources
প্রশ্ন – নিরপেক্ষ বচন কয় প্রকার ও কি কি?
উত্তর – গুণ ও পরিমাণ অনুসারে নিরপেক্ষ বচন চার প্রকার-
ক) সামান্য সদর্থক(Universal Affirmative)
খ) সামান্য নঞর্থক(Universal Negative)
গ) বিশেষ সদর্থক(Particular Affirmative)
ঘ) বিশেষ নঞর্থক(Particular Negative )
প্রশ্ন – যৌগিক বচন কয় প্রকার ও কি কি?
উত্তর – যৌগিক বচন পাঁচ প্রকার হতে পারে-
ক) নিষেধক বচন
খ) সংযোগিক বচন
গ) প্রাকল্পিক বচন
ঘ) বৈকল্পিক বচন ও
ঙ) প্রাতিকল্পিক বচন
প্রশ্ন – সাপেক্ষ বচন কয় প্রকার ও কি কি?
উত্তর – সাপেক্ষ বচন দুই প্রকার-
ক) প্রাকল্পিক বচন
খ) বৈকল্পিক বচন
প্রশ্ন – পদের ব্যাপ্যতা বলতে কী বোঝায়?
উত্তর – নিরপেক্ষ বচনে কোন পদের সমগ্র ব্যক্তার্থকে গ্রহণ করলে সেই নিরপেক্ষ বচনের সেই পদটিকে ব্যাপ্য বলা হয়।
প্রশ্ন – নঞর্থক বচন কাকে বলে?
উত্তর – ঘোষণা করা হয় যে উদ্দেশ্য পদ নির্দেশিত শ্রেণীটি বিধেয় পদ নির্দেশিত শ্রেণীর বহির্ভূত, সেই বচনকে নঞর্থক বচন বলা হয়।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবতাবাদ | Discuss the Tagore Humanism
- মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো | Features of Mahatma Gandhi’s Non-Violence Policy
- কান্টের নৈতিকতা ও শান্তির মধ্যে সম্পর্ক | Kant’s Relationship Between Morality and Peace
- ব্যাপ্তি কাকে বলে | ব্যাপ্তি কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় | What is Vyapti
- দর্শনের স্বরূপ আলোচনা করো | The Nature of Philosophy