প্রমাণ প্রসঙ্গে চার্বাকদের একটি বিখ্যাত উক্তি হল প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ (Perception is the Only Source of Knowledge)। প্রত্যক্ষ ব্যতীত অন্য কোন প্রমাণকে চার্বাকরা অস্বীকার করেন।
প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ | Perception is the Only Source of Knowledge
চার্বাক দর্শনের যৌক্তিক ভিত্তি হলো তাদের জ্ঞানতত্ত্ব। জ্ঞানতত্ত্ব- যেখানে জ্ঞানের স্বরূপ, জ্ঞানের উৎস এবং জ্ঞানের সীমা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচিত হয়।
যথার্থ অনুভবকে বলে প্রমা। প্রমার করন কে বলা হয় প্রমাণ। প্রমা বা যথার্থ অনুভব যার দ্বারা হয়ে থাকে সেটাই হলো প্রমাণ। জ্ঞানতত্ত্বে চার্বাকদের অনিবার্য সিদ্ধান্ত হলো প্রত্যক্ষ একমাত্র প্রমাণ (Perception is the Only Source of Knowledge)। অর্থাৎ চার্বাকরা সকল প্রমাণের একমাত্র প্রমাণ রূপে প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করেছেন।
চার্বাক মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ (According to Carvaka Perception is the Only Source of Knowledge) যা সকল প্রমাণের মূল প্রমাণ। এ কারণে অনুমান, উপমান, শব্দ প্রভৃতি প্রমাণ যথার্থ জ্ঞান লাভের উপায় হতে পারে না বলে চার্বাকরা মনে করেন।
চার্বাকরা হলেন প্রত্যক্ষ প্রমাণবাদী। তারা প্রত্যক্ষকে প্রমাণ বলতে চান এবং একমাত্র প্রমাণ হিসেবে তারা প্রত্যক্ষকেই স্বীকার করেছেন। ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উৎপন্ন সম্যক অপরোক্ষ অনুভব হল প্রত্যক্ষ। প্রত্যক্ষকে প্রমাণ বলার পিছনে চার্বাকদের বিভিন্ন যুক্তি রয়েছে সেগুলি নিম্নরূপ –
প্রত্যক্ষ হল সাক্ষাৎ অনুভব
প্রত্যক্ষ হল সাক্ষাৎ অনুভব। আর এই অনুভব হল ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সন্নিকর্ষের ফলে যে অনুভব উৎপন্ন হয় তা হল প্রত্যক্ষ।
চোখ দিয়ে আমরা ঘটকে প্রত্যক্ষ করলে, আমাদের চোখের সঙ্গে ঘটের একপ্রকার সন্নিকর্ষ হয়ে থাকে। স্মৃতির সঙ্গে প্রত্যক্ষের পার্থক্যকরনের জন্যই অনুভব শব্দটিকে উল্লেখ করা হয়েছে। স্মৃতিজনিত যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাকে সংস্কার বলা হয়।
প্রত্যক্ষ হল অপরোক্ষ অনুভব
চার্বাকদের মতে প্রত্যক্ষ হল অপরোক্ষ অনুভব, যে অনুভব সরাসরি লাভ করা হয়। যা আগের কোনও জ্ঞানের বা অনুভবের উপর তা নির্ভর করে না, তাকে অপরোক্ষ অনুভব বলা হয়। কোন বস্তুকে দেখে বস্তুর যে জ্ঞান তা অন্য কোন জ্ঞানের উপর নির্ভর করে না।
যেমন কোন ঘটকে দেখে সেটি যে ঘট, এমন জ্ঞান যা অন্য কোন জ্ঞানের উপর নির্ভর করে না। এই জ্ঞান হল সরাসরি, অপরোক্ষ অনুভব। চার্বাকরা এমনই অপরোক্ষ অনুভবকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলেছেন।
প্রত্যক্ষ হল সম্যক অনুভব
চার্বাক মতে প্রত্যক্ষ হল সম্যক অনুভব।এখানে সম্যক বলতে সংশয়হীন ও বিপর্যয়মুক্ত জ্ঞানের কথা বোঝানো হয়েছে। সংশয় বলতে আমরা সেই সমস্ত জ্ঞানকে বুঝে থাকি যে সমস্ত জ্ঞান অনিশ্চিত।
যেমন উত্তপ্ত মরুভূমিতে দূর থেকে দেখে জলাশয় মনে হলেও আদতে তা জল কি না এমন জ্ঞান অনিশ্চিত জ্ঞান। কিন্তু প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞান সংশয়শুন্য, সুনিশ্চিত জ্ঞান হয়ে থাকে।
বিপর্যয় বলতে আমরা মিথ্যা জ্ঞানকে বুঝে থাকি। যেমন কোন বস্তুকে অর্থাৎ এক কে দুই বলে জানা, এরূপ মিথ্যা জ্ঞানকে বিপর্যয় বলা হয়। কিন্তু প্রত্যক্ষ জ্ঞানে বিপর্যয় নেই। প্রত্যক্ষ জ্ঞান হল সম্যক জ্ঞান যা বিপর্যয় শুন্য। যার দ্বারা নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা যায়।
চার্বাক মতে প্রত্যক্ষ প্রমাণই একমাত্র মূল প্রমাণ (Perception is the Only Source of Knowledge)। প্রত্যক্ষ জ্ঞান বস্তু থেকে সরাসরি আসে। এই প্রত্যক্ষ জ্ঞান এতই স্পষ্ট যে এই জ্ঞানের যথার্থতা সম্বন্ধে কোন সংশয় দেখা যায় না। প্রত্যক্ষ মূলত দু’রকম ভাবে হয়ে থাকে প্রথমত, বাহ্যপ্রত্যক্ষ দ্বিতীয়ত, মানষপ্রত্যক্ষ।
আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় যথা- চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এগুলির মাধ্যমে বাইরের জগতের যে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ হয়ে থাকে তাকে বলা হয় বাহ্যপ্রত্যক্ষ এবং সুখ-দুঃখ প্রভৃতি মানসিক অবস্থা যেগুলির মনের সাহায্যে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ হয়ে থাকে তাকে বলা হয় মানষপ্রত্যক্ষ।
অনুমান, শব্দ ইত্যাদি প্রমাণকে যারা স্বীকার করেছেন তারাও প্রত্যক্ষকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ মানেন। তারা সকল প্রমাণের মূল প্রমাণ হিসেবে প্রত্যক্ষকে (Perception is the Only Source of Knowledge) স্বীকৃতি দিয়েছেন।
প্রত্যক্ষ ছাড়া অনুমান সম্ভব নয়। কারণ পর্বতে ধুমকে প্রত্যক্ষ না করলে সেখানে যে বহ্নি রয়েছে এমন অনুমান সম্ভব হবে না। আবার শব্দ প্রত্যক্ষ বা শব্দকে শ্রবণ না করলে শব্দের অর্থকে জানা যাবে না। তেমনি সকল প্রমাণই প্রত্যক্ষের উপর নির্ভরশীল।
চার্বাকরা আরো মনে করেন এই প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞান মানুষকে বিভ্রান্ত করে না। যে জ্ঞান লোক ব্যবহারে সক্ষম। সাধারণ মানুষ মনে করেন যে তারা যা কিছু প্রত্যক্ষ করছে সেগুলির অস্তিত্ব রয়েছে। সুতরাং চার্বাকদের প্রত্যক্ষ একমাত্র প্রমাণ (Perception is the Only Source of Knowledge) এই অভিমত সাধারণ মানুষের মতের সহিত সঙ্গত।
উপসংহার
পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে প্রত্যক্ষ একমাত্র প্রমাণ এই মতের স্বপক্ষে চার্বাকরা যথেষ্ট যুক্তি প্রদান করেছেন। তাছাড়া বাস্তবিক জীবনে প্রত্যক্ষই সমস্ত প্রমাণের মূল প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃত।তবে চার্বাকদের এই প্রত্যক্ষ একমাত্র প্রমাণ (According to Carvaka Perception is the Only Source of Knowledge) যুক্তিগ্রাহ্য হলেও এর বিরুদ্ধে নানান অভিমত ও সমালোচনাও রয়েছে।
তথ্যসূত্র (References)
- Classical Indian Philosophy: J.N. Mohanty
- Outlines of Indian Philosophy: M. Hiriyanna
- An Introduction to Indian Philosophy: D. M. Dutta & S.C. Chatterjee
- A Critical Survey of Indian Philosophy: C.D. Sharma
- Classical Indian Ethical Thought: K.N. Tewari
- The Ethics of the Hindus: S.K. Maitra
- Outlines of Indian Philosophy: J.N. Sinha
- Internet Source
প্রশ্ন – আস্তিকও নাস্তিক শব্দ দুটির অর্থ কি?
উত্তর – ভারতীয় দর্শনের আস্তিক সম্প্রদায় বলতে তাদেরকে বোঝানো হয় যারা বেদে প্রামাণ্যকে স্বীকার করেছেন এবং নাস্তিক সম্প্রদায় বলতে তাদের কে বোঝানো হয় যারা বেদের প্রামাণ্যকে অস্বীকার করেন।
প্রশ্ন – চার্বাক মতে প্রমাণ কি?
উত্তর – চার্বাকরা প্রমাণ বলতে কেবল প্রত্যক্ষকেই স্বীকার ও স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাদের মতে প্রত্যক্ষই হলো একমাত্র প্রমাণ, যে প্রমাণ অভ্রান্ত ও নিশ্চিত জ্ঞান দিতে পারে। যা সকল প্রমাণের মূল ভিত্তি।
প্রশ্ন – চার্বাকরা আস্তিক না নাস্তিক সম্প্রদায়?
উত্তর – চার্বাকরা হলেন নাস্তিক সম্প্রদায় ভুক্ত। কারণ ভারতীয় দর্শনে নাস্তিক বলতে তাদেরকে বোঝানো হয় যারা বেদের প্রামাণ্যকে অস্বীকার করেছেন। বেদের প্রামাণ্যকে চার্বাকরা স্বীকার করেন না। কারণ তারা প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করেন। যেহেতু বেদবাক্য প্রত্যক্ষ যোগ্য নয় তাই তাকে চার্বাকরা স্বীকৃতি দেন না।
- প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ চার্বাকদের উক্তিটি ব্যাখ্যা কর | Perception is the Only Source of Knowledge
- ব্যাপ্তি গ্রহের উপায় গুলি কি কি | What are the Ways to Identify of Vyapti
- চিরস্থায়ী শান্তি সংক্রান্ত কান্টের মতবাদ | Kant’s Doctrine of Perpetual Peace
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবতাবাদ | Rabindranath Tagore Humanism
- মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো | Features of Mahatma Gandhi’s Non-Violence Policy