দর্শনের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো | Discuss the Characteristics of Philosophy

দর্শন যেহেতু সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তাই সামগ্রিকতার মধ্যে থেকে দর্শনের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Philosophy) গুলিকে নিঃসরণ করা অত্যন্ত কঠিন।

তাই দর্শনের বিষয়বস্তু, সমস্যা, আলোচনার পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি বিষয়গুলির আলোচনার মাধ্যমে দর্শনের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Philosophy) গুলি সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু ধারণা গঠন করা যায়।

দর্শনের বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Philosophy

দর্শনের সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নেই। সমগ্র বিশ্ব দর্শনের আলোচনার ক্ষেত্রে রূপে বিবেচিত হয়। মানুষের সমস্ত ধরনের অভিজ্ঞতা (যেমন- জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজ-রাষ্ট্র, নীতি-ধর্ম, সৌন্দর্যমূলক অভিজ্ঞতা এই শাস্ত্রের আলোচ্য বিষয়। বর্তমানে বাণিজ্য, ইতিহাস, প্রভৃতি অনেক নতুন নতুন বিষয় এই শাস্ত্রের পরিসীমার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। হলো তো দর্শনের শাখার বিস্তার ঘটেছে বহুতর। দর্শন তাই একটি সর্বব্যাপক শাস্ত্রে রূপায়িত হয়েছে।

দর্শনের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Philosophy) গুলি নিম্নে আলোচিত হল –

বৈশিষ্ট্যরূপে দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি

দর্শনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার দৃষ্টিভঙ্গি। দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি হল সামগ্রিক, সার্বিক, ব্যাপক ও সমন্বয়ী।জ্ঞানের প্রতিটি শাখা একটি নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু আলোচনা করে। এই অর্থে শাখা গুলির দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। দর্শন সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়বস্তু আলোচনা করে।

বিজ্ঞান যেমন একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে, প্রকৃতিকে নানাভাবে বিভক্ত করে এক একটি ভাগ নিয়ে আলোচনা করে থাকে। অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বজগৎ তার আলোচনার বিষয় না।

কিন্তু দর্শনের ক্ষেত্রে তার আলোচনার বিষয় হলো সামগ্রিক অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বই তার আলোচনার বিষয়বস্তু। দর্শন সমস্ত বিশ্ব প্রকৃতিকে সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধভাবে ও সামগ্রিকভাবে দেখে। যত রকমের বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা রয়েছে সেগুলিকে এই সমগ্র বিশ্ব জগতের পরিপ্রেক্ষীতে সমন্বয় করে জগতের একটা সার্বিক ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়াস করে।

বৈশিষ্ট্যরূপে বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা

বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা হল দর্শনের একটি বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Philosophy)। জ্ঞানের প্রতিটি শাখার নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু আছে। কিন্তু দর্শনের কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নেই। দর্শন জগৎ ও জীবন সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতাগুলিকে বিচার করে সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করে। সুতরাং জ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যেগুলি দর্শন আলোচনা করে না। তাই দর্শণ এমন একটি বিষয় যা জগৎ ও জীবন প্রভৃতি সম্পর্কে সামগ্রিক এবং সামাজিক বিচার বিবেচনার মাধ্যমে যুক্তিযুক্ত মূল্যায়ন।

বৈশিষ্ট্যরূপে দর্শনের লক্ষ্য

দর্শনের আরো একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Philosophy) হলো তার লক্ষ্য।দর্শনের লক্ষ্য হল তত্ত্ব বা সত্যের স্বরূপ উপলব্ধি করা। দর্শন মানে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ নয়। কেবল আমরা যা প্রত্যক্ষ করি মাত্র তেমন কিছুই দর্শন নয়। সাধারণ দেখার বাইরে গভীরভাবে সেই বস্তুর সত্য-তত্ত্ব উপলব্ধি করা, সে সম্পর্কে জানা হল দর্শন।

বিজ্ঞান যেমন জীবজগৎকে নিয়ে আলোচনা করে, দর্শনও তেমন জীবজগৎ নিয়ে আলোচনা করে। তবে তাদের আলোচনা মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে, তা হল বিজ্ঞান অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষভাবে এগুলিকে দেখে কিন্তু দর্শন দেখে অভিজ্ঞতা সাপেক্ষভাবে। তাই বিজ্ঞান কেবল বস্তুকে বস্তু হিসেবেই দেখে, তা অভিজ্ঞতার বিষয় হিসেবে দেখেনা।

বৈশিষ্ট্যরূপে দর্শনের পদ্ধতি

দর্শনের নিজস্বতা বা তার পদ্ধতিই হল দর্শনের আরও একটি বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Philosophy)।বিজ্ঞানের পদ্ধতি থেকে দর্শনের পদ্ধতি কিছুটা আলাদা। পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ হল বিজ্ঞানের পদ্ধতি। অপরদিকে দর্শনের পদ্ধতি হল বিচার ও মনন। দর্শন বিচারমূলক মননের সাহায্যে জগৎ ও জীবন সম্পর্কীত প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়।

বৈশিষ্ট্যরূপ দর্শনের উৎস

দর্শনের উৎস কোথা থেকে? এই নিয়ে নানান দার্শনিক তাদের বিভিন্ন মতবাদ পোষণ করেন। তবে এই দর্শন কোথা থেকে সৃষ্টি হল এমন চিন্তা ধারা বিচার-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে  দার্শনিক প্লেটো বলেন বিস্ময়ই দর্শনের জনক। এই জগৎ ও জীবন মানুষের মনে বিস্ময় সৃষ্টি করে। এই সুশৃঙ্খল, বৈচিত্র্যময় জগৎ কিভাবে সৃষ্টি হল, কে এর সৃষ্টিকর্তা? এই শৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ কর্তা কে? এইসব একাধিক প্রশ্ন মানুষের মনে ভিড় করে। এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টা থেকেই দর্শনের আবির্ভাব।

হার্বার্ট স্পেন্সার(Herbert Spencer), বার্টান্ড  রাসেল (Bartrand Russell) প্রমুখ বস্তুবাদী দার্শনিকগণ মনে করেন, “দর্শন হলো ব্যাপকতর বিজ্ঞান”। দর্শনের কাজ হল বিভিন্ন বিজ্ঞানের ফলাফল গুলিকে ব্যাখ্যা করে তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। কিছু চিন্তাবিদ মনে করেন যে দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পূর্ণ পৃথক। যেহেতু এদের পদ্ধতি ও আলোচনার বিষয় সম্পূর্ণ পৃথক।

প্লেটো(Plato), অ্যারিস্টটল(Aristotle) প্রমুখ দার্শনিক মনে করেন অধিবিদ্যাই হল দর্শন।

কিন্তু আধুনিক যুগে এ.জে.এয়ার(Alfred Jules  Ayer)প্রমূখ দার্শনিক মনে করেন যে দার্শনিক আলোচনার ক্ষেত্রে অধিবিদ্যার কোন স্থান নেই।  তাঁরা মনে  করেন “দর্শন হল বিজ্ঞানের বচনগুলির তর্কশাস্ত্রসম্মত বিশ্লেষণ”।

ইমানুয়েল কান্ট(Immaniel Kant), জে. জি. ফিক্‌টে(Johann Gottlielo Fichte)প্রমুখ বিচারবাদী দার্শনিকরা মনে করেন যে দর্শন(Philosophy) ও জ্ঞানবিদ্যা(Epistemology) অভিন্ন।

তারা মনে করেন “দর্শন হল জ্ঞানের তত্ত্ব  বা বিজ্ঞান”। আবার অনেক চিন্তাবিদ বলেন জ্ঞানবিদ্যা হল দর্শনের একটি বিশেষ শাখা।

আরোও পড়ুন – Click here

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায় দর্শনকে যেমন কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়িত করা যায় না, ঠিক তেমনি তার বৈশিষ্ট্য গুলিকে নির্দিষ্টভাবে সীমায়ীত করা একেবারে সম্ভব নয়। তবে দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি, তার বিষয়বস্তু এবং তার লক্ষ্য এসবের মাধ্যমে দর্শনের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Philosophy) গুলিকে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।

তথ্যসূত্র (References)

  • History of Western Philosophy: B. Russell
  •  History of Modern Philosophy: R. Falckenberg
  •  A History of Philosophy: F. Thilly
  •  A History of Modern Philosophy: W.K. Wright
  • Internet Sources

প্রশ্ন – দর্শন কথাটির অর্থ লেখো।

উত্তর – দর্শন কথাটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা ভালোবাসা।দর্শন শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Philosophy। এই Philosophy শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ ‘Philos’ এবং ‘Sophia’ থেকে উদ্ভুত।‘Philos’ শব্দের অর্থ হল অনুরাগ এবং ‘Sophia’ শব্দটির অর্থ জ্ঞান (Knowledge)।

প্রশ্ন – দর্শন এর কাজ কী?

উত্তর – যে সত্য বা তত্ত্ব সমগ্র বিশ্বে নিহিত। যা থেকে এই বিশ্বের চেতন, অচেতন সকল কিছুই উদ্ভূত। দর্শন এর কাজ হল সেই পরম সত্যকে দেখা, উপলব্ধি করা, জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা।

প্রশ্ন – দর্শনের ভিত্তি কি?

উত্তর – বাস্তবতা,আদর্শবাদ,বর্তমানবাদ,যৌক্তিকতা,নৈতিকতা,সত্য,যুক্তি ইত্যাদি হল দর্শনের ভিত্তি।

Leave a Comment