হেতু ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ত সহচার বা সাহচর্য সম্বন্ধ হল ব্যাপ্তি।ব্যাপ্তিকে জানার সাথে সাথে ব্যাপ্তি গ্রহের উপায় গুলি কি কি (What are the ways to identify of Vyapti) তা জানা দরকার।
ব্যাপ্তি |Vyapti
ব্যাপ্তি বলতে আমরা হেতু ও সাধ্যের মধ্যে সহচার নিয়মকে বুঝে থাকি। সহচার বা সাহচর্য সম্বন্ধকে আরো বিস্তারিত জানতে হলে ‘সহচার’ ও ‘নিয়ম’ পৃথক শব্দ দুটির অর্থ ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
‘সহচার‘ হল একাধিকরণ বা সমানাধিকরণ অর্থাৎ দুটি বিষয় একই অধিকরণে থাকাকে সহচর সম্বন্ধ বলা হয়। এক্ষেত্রে ধুম ও অগ্নির মধ্যে সহচার সম্বন্ধ পরিলক্ষিত হচ্ছে। কেননা যেখানে ধুম সেখানে অগ্নি আবার যেখানে অগ্নির অভাব সেখানে ধূমেরও অভাব পরিলক্ষিত হয়।
‘নিয়ম’ হল নিয়ত বা ব্যতিক্রমহীন। অর্থাৎ নিয়ম হল তাই যেখানে কোনও ব্যতিক্রম থাকেনা। এক্ষেত্রে সহচার নিয়ম বলতে আমরা বুঝি ব্যতিক্রমহীন সাহচর্যকে। দুটি বিষয়ের সাহচর্য যদি ব্যতিক্রমহীন হয় তাহলে তাদের মধ্যে সহচার নিয়ম উল্লেখিত হয়। যেমন A ও B এর মধ্যে সম্পর্ক যদি এরূপ হয় যে A থাকলে B থাকে, আবার B না থাকলে A ও থাকে না। তাহলে তাদের মধ্যে যে সম্বন্ধ তা হল সহচার নিয়মের সম্বন্ধ।
ব্যাপ্তি গ্রহের উপায় |Ways to Identify of Vyapti
ব্যাপ্তি গ্রহের উপায় (Ways to Identify of Vyapti) হিসাবে নৈয়ায়িকরা সাতটি পদ্ধতির উল্লেখ করেছেন, যে পদ্ধতিগুলি মাধ্যমে ব্যাপ্তির প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ব্যাপ্তি গ্রহের উপায় গুলি যথাক্রমে অন্বয়, ব্যতিরেক, ব্যাভিচারাগ্রহ, ভূয়োদর্শন, উপাধিনিরাস, তর্ক ও সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষ।
অন্বয়
সাদৃশ্য বা মিল হল অন্বয় শব্দের অর্থ। দুটি পদার্থের মধ্যে সাদৃশ্য বা মিল প্রত্যক্ষ করে পদার্থ দুটির মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধকে জানা যায়। ধূম ও বহ্নিকে বারবার একইসঙ্গে উপস্থিত দেখে দুটির মধ্যে অন্বয় প্রত্যক্ষ করে জানা যায় যে ধুম ও বহ্নির মধ্যে ব্যাপ্তি (Vyapti) সম্বন্ধ আছে। যেমন- গোশালা, যোগ্যশালা, পাকশালা প্রভৃতি স্থানে ধূম এবং বহ্নি বা অগ্নির একত্রিত উপস্থিতি বা অন্বয় প্রত্যক্ষ করে তাদের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্পর্ককে জানা যায়।
ব্যতিরেক
ব্যতিরেক শব্দের অর্থ হল অনুপস্থিতি বা অভাব। দুটি বিষয়ের মধ্যে যখন একত্র অনুপস্থিতি থাকে, তা প্রত্যক্ষ করার পর বিষয়টির মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ আছে তা নির্ণয় করা যায়। যেখানে বহ্নি নেই সেখানে ধূমও নেই। সমুদ্রে, জলাশয়ে বহ্নি নেই এবং ধূমও নেই। এই সকল ক্ষেত্রে ধূম ও বহ্নির একত্রে অনুপস্থিতি বা ব্যতিরেক লক্ষ্য করা যায় এবং তাদের মধ্যে ব্যাপ্তি (Vyapti) সম্বন্ধ পরিলক্ষিত হয়।
ব্যাভিচারাগ্রহ
ব্যাপ্তি নির্ণয়ের আরেকটি উপায় হল ব্যাভিচারাগ্রহ। ‘ব্যভিচার’ বলতে যা বোঝায় তা হল ‘বিরুদ্ধ দৃষ্টান্ত’ বা বিপরীত দৃষ্টান্ত আর ‘আগ্রহ’ বলতে আমরা ‘অদর্শন’ বা দেখতে না পাওয়াকে বুঝে থাকি। সুতরাং ব্যাভিচারাগ্রহ কথার অর্থ হল বিরুদ্ধ বা বিপরীত দৃষ্টান্তের অভাব। যেখানে ধূম সেখানেই বহ্নি।ধূম আছে অথচ বহ্নি নেই এমন বিপরীত দৃষ্টান্ত আমরা কখনও প্রত্যক্ষ করি না। সুতরাং ধূম এবং বহ্নির মধ্যে একপ্রকার সম্বন্ধ আছে এরূপ বলা যেতে পারে, আর তা হল ব্যাপ্তি (Vyapti) সম্বন্ধ।
ভূয়োদর্শন
ভূয়োদর্শন বলতে একই জিনিসের বারবার প্রত্যক্ষ বা যাচাইকে বুঝে থাকি। বারবার সহচার দর্শনকে ন্যায় মতে ভূয়োদর্শন বলা হয়। সহচার দর্শন ব্যাপ্তি জ্ঞানের ক্ষেত্রে আবশ্যক। ব্যাপ্তি হল হেতু ও সাধ্যের মধ্যে সহচার নিয়ম। তাই এক্ষেত্রে বারবার বিভিন্ন স্থানে, যেমন – যজ্ঞবেদী, পর্বত ইত্যাদি স্থানে ধূম ও বহ্নির একত্রে উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা প্রয়োজন।
উপাধিনিরাস
উপাধিনিরাস কথার অর্থ হল ‘শর্ত নিরাস’ বা শর্তকে নিরসন। এক্ষেত্রে ‘উপাধি’ হল ‘শর্ত’। সুতরাং উপাধি বা শর্ত থাকলে ব্যাপ্তি জ্ঞান হয় না। ব্যাপ্তি সম্বন্ধ উপাধিবিহীন সম্বন্ধ। ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে হেতু ও সাধ্যের মধ্যে যেরূপ ব্যাপ্তি সম্বন্ধের কথা বলা হচ্ছে তা উপাধিমুক্ত হওয়া জরুরী। যেমন ধূম ও বহ্নির ক্ষেত্রে সহচার উপাধিমুক্ত। কিন্তু বিপরীতভাবে বহ্নির সঙ্গে ধূমের যে সম্বন্ধ তা উপাধিযুক্ত। কারণ ভিজে কাঠে বহ্নি সংযোগ করলে তবে ধূম উৎপন্ন হয়। এক্ষেত্রে ভিজে কাঠ হল উপাধি বা শর্ত। বলতে হয় বহ্নির সঙ্গে ধূমের ব্যাপ্তি সম্বন্ধ নেই কিন্তু ধূম ও বহ্নির মধ্যে সম্বন্ধ হল সহচর সম্বন্ধ যা উপাধিমুক্ত।
তর্ক
ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আরও একটি পদ্ধতি হল তর্ক। এই তর্ক পদ্ধতির সাহায্যে ব্যাপ্তিকে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।ব্যাপ্তি সম্পর্কে যদি সংশয়বাদীরা সংশয় প্রকাশ করেন তাহলে তর্কের মাধ্যমে তাদের সংশয়কে দ্রবীভূত করা যেতে পারে। সংশয়বাদীরা বলতে পারেন যে অন্বয়, ব্যতিরেক, ব্যাভিচারাগ্রহ প্রভৃতি দ্বারা যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা হয় তা যথার্থ নাও হতে পারে। কেননা সেই সম্বন্ধ যে ভবিষ্যতেও একই রূপ সত্য হবে এরূপ কোন নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। ভবিষ্যতে এমনও হতে পারে যে বহ্নি ছাড়াই ধূমের অস্তিত্ব থাকতে পারে।
সংশয়বাদীদের সংশয় কে দূরীভূত করানোর জন্য নৈয়ায়িকরা তর্কের সাহায্যে বলেন ‘সব ধুমবান বস্তু হয় বহ্নিমান’ এই সামান্য বচন সত্য না হলে এর বিরুদ্ধ বচন ‘কোন কোন ধুমবান বস্তু নয় বহ্নিমান’ তা অবশ্যই সত্য হবে। কিন্তু এ কথার অর্থ হল কারণ ছাড়াই কার্য থাকতে পারে। কিন্তু কারণ ছাড়া কার্য উৎপন্ন হয় না এমনটাই প্রতিষ্ঠিত। ধূম সৃষ্টি বা ধূম উৎপন্ন করতে হলে সেখানে বহ্নি থাকতেই হবে। এরূপ তর্কের মাধ্যমে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ
সামান্য বলতে কোন কিছুর জাতিকে বোঝানো হয়। যখন আমরা কোন একটি স্থানে যেমন রান্নাঘর বা যোগ্যশালা ইত্যাদি স্থানে কোন একটি বিশেষ ধূমকে প্রত্যক্ষ করি তখন সেই ধূমের জাতি ধূমত্বকেও প্রত্যক্ষ করি। আমরা ওই স্থানে বহ্নির জাতি বহ্নিত্বকেও প্রত্যক্ষ করি। ন্যায় মতে ধূমত্ব ও বহ্নিত্ব প্রত্যক্ষকালে সকল ধূম ও সকল বহ্নির সঙ্গে চক্ষু ইন্দ্রিয়ের অলৌকিক সন্নিকর্ষ হয়। এইভাবে বিভিন্ন স্থানে ধূম ও বহ্নির সহচার দর্শন হলেই ব্যাপ্তি জ্ঞান হয়ে থাকে।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, হেতু ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ত সহচার সম্বন্ধ হল ব্যাপ্তি।ব্যাপ্তি গ্রহের ৭টি উপায় ( ways to identify of Vyapti) হিসাবে অন্বয়, ব্যতিরেক, ব্যাভিচারাগ্রহ, ভূয়োদর্শন, উপাধিনিরাস, তর্ক ও সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষ ইত্যাদি পদ্ধতি গুলি উল্লেখযোগ্য।
তথ্যসূত্র (References)
- Outlines of Indian Philosophy: M. Hiriyanna
- A Critical Survey of Indian Philosophy: C.D. Sharma
- An Introduction to Indian Philosophy: D. M. Dutta & S.C. Chatterjee
- Classical Indian Philosophy: J.N. Mohanty
- History of Indian Philosophy: S.N. Dasgupta
- Internet Sources
প্রশ্ন – Meaning of Vyapti?
উত্তর – ব্যাপ্তির অর্থ হল হেতু ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ত সহচার বা সাহচর্য সম্বন্ধ।
- ব্যাপ্তি গ্রহের উপায় গুলি কি কি | What are the Ways to Identify of Vyapti
- চিরস্থায়ী শান্তি সংক্রান্ত কান্টের মতবাদ | Kant’s Doctrine of Perpetual Peace
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবতাবাদ | Rabindranath Tagore Humanism
- মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো | Features of Mahatma Gandhi’s Non-Violence Policy
- কান্টের নৈতিকতা ও শান্তির মধ্যে সম্পর্ক | Kant’s Relationship Between Morality and Peace