ইমানুয়েল কান্ট তার ‘চিরস্থায়ী শান্তি’ সংক্রান্ত মতবাদে (Kant’s Doctrine of Perpetual Peace) রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে মনে করতেন।
ইমানুয়েল কান্ট তার ‘চিরস্থায়ী শান্তি’ (Perpetual Peace) গ্রন্থে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন প্রস্তাবনা কে উত্থাপিত করেছেন তিনি বিশ্বাস করতেন যে রাজনৈতিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
চিরস্থায়ী শান্তি সংক্রান্ত কান্টের মতবাদ | Kant’s Doctrine of Perpetual Peace
ইমানুয়েল কান্ট এর চিরস্থায়ী শান্তি সংক্রান্ত মতবাদ (Kant’s Doctrine of Perpetual Peace) একটি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখযোগ্য মতবাদ যেখানে কান্ট মনে করতেন চিরস্থায়ী শান্তি (Perpetual Peace) অর্জন করতে হলে প্রয়োজন হয় প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান, জাতিসংঘের একটি ফেডারেল কাঠামো এবং আন্তর্জাতিক আইন প্রতিষ্ঠার।যা যুদ্ধের পরিবর্তে একপ্রকার আলোচনার মাধ্যমে সমস্ত রকম সমস্যাকে সমাধানের পথে ত্বরান্বিত করবে।
চিরস্থায়ী শান্তি সংক্রান্ত কান্টের মতবাদ (Kant’s Doctrine of Perpetual Peace) নিম্নে আলোচিত হলো –
প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান
ইমানুয়েল কান্ট মনে করতেন প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরে সংবিধান অর্থাৎ প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান থাকা দরকার। যেখানে জনগণের ইচ্ছায় ও জনগণের মতামতের দ্বারা সরকারের গঠন হবে। এই প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান হবে সরকারের মূল ভিত্তি। তিনি মনে করতেন যে প্রত্যেক দেশের সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হতে হবে এবং জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। সরকার সর্বদা যুদ্ধ বা আগ্রাসনের পরিবর্তে শান্তির পথকে বেছে নেবে এবং সেই পথেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
কান্ট প্রস্তাব করেছিলেন যে, বিভিন্ন দেশের একটি ফেডারেল কাঠামো তৈরি করা উচিত, যেখানে প্রতিটি দেশ তাদের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে একটি সম্মিলিত আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে কাজ করবে। এই কাঠামো আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
জাতিসমূহের ফেডারেল কাঠামো
বিভিন্ন দেশ গুলির মধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠিত হওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ জাতিসংঘের একটি ফেডারেশন থাকা উচিত বলে তিনি মনে করতেন। যার দ্বারা অধিকার রক্ষা এবং সমস্ত রকম সমস্যা সমাধানের জন্য একে অন্যের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে নিতে পারবে। কান্ট আরো মনে করতেন যে বিভিন্ন দেশের একটি ফেডারেল কাঠামো নির্মাণ করা দরকার। যার সাহায্যে প্রত্যেকটি দেশ তাদের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখবে এবং একটি সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে তারা কাজ করবে। যে কাঠামো হবে আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার একটি আধার।
আন্তর্জাতিক আইন প্রতিষ্ঠা
ইমানুয়েল কান্ট মনে করতেন একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক আইন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। যার দ্বারা সমস্ত জাতিগুলোর মধ্যে বিরোধিতার সম্পর্ককে দমন করা সম্ভব হবে এবং তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তি রক্ষা করা যাবে। যে আইন বিরোধগুলিকে মীমাংসার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে অংশ নেবে।
সার্বজনীন আতিথিয়তা
সমস্ত জাতিগুলোর মধ্যে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা শ্রদ্ধাশীলতা ও সুসম্পর্ক গড়ে তোলা একান্ত আবশ্যিক হওয়া উচিত। কারণ এসবের দ্বারা কোন জাতি অন্য কোন জাতিকে অত্যাচার, তার ওপর আধিপত্য স্থাপন ইত্যাদি নানারকম কুরুচিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়াকে রোধ করা যাবে। আর তা না হলে জাতিগুলোর মধ্যে একে অন্যের সাথে বিবাদ, বিরোধ লেগেই থাকবে। যাতে এক অশান্তকর পরিস্থিতি তৈরি করার যোগ্য পরিবেশ গড়ে উঠবে। যা কখনোই শান্তি আহ্বায়ক হতে পারবে না।
যুদ্ধ পরিহার
ইমানুয়েল কান্ট মনে করতেন জাতির সবচেয়ে বড় বিপদের পরিস্থিতি হল যুদ্ধ। তিনি যুদ্ধকে কখনোই শ্রেয় বলে মনে করতেন না। সর্বদাই তার অভিমত ছিল যুদ্ধের বিপক্ষে। তিনি শান্তিকে শ্রেয় বলে মনে করতেন। তাই চিরস্থায়ী শান্তি (Perpetual Peace) অর্জনের জন্য যুদ্ধের পরিবর্তে আলোচনার পথকে বেছে নিয়ে শান্তিকে অক্ষুন্ন রাখা কর্তব্য বলে তিনি মনে করতেন।
জাতি সমূহের অধিকার
প্রত্যেক দেশের, প্রত্যেক জাতির নিজস্ব অধিকার, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রয়েছে। যেগুলির রক্ষার জন্য একটি আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োজন জরুরী বলে কান্ট মনে করতেন। যে আইনের মাধ্যমে জাতিগুলোর নিজস্ব সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতা রক্ষা হবে এবং মূলত জাতিগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সুসম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হবে।
গণতান্ত্রিক শান্তি তত্ত্ব
কান্ট মনে করতেন গণতান্ত্রিক শান্তি তত্ত্ব হল এমন এক প্রকার অবস্থান যেখানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের শান্তি বজায় রাখতে অন্য রাষ্ট্রগুলোর সাথে কম সংঘাতে লিপ্ত হবে। প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের আভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য কোন পররাষ্ট্রের সাথে যাতে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়তে হয় সেজন্য একে অন্যের সাথে শান্তির অবস্থানকে অক্ষুন্ন রাখতে চেষ্টা করে।
নৈতিকতা ও বাধ্যবাধকতা
ইমানুয়েল কান্ট এর মতে প্রত্যেক দেশ তথা রাষ্ট্রের জনগণ, প্রত্যেক জাতি তথা সরকারের উচিৎ নৈতিকভাবে শান্তির জন্য সমবেত হওয়া ও শান্তির জন্য মিলিত ভাবে কাজ করা। কারণ রাষ্ট্রের জন্য শান্তি যেমন প্রয়োজন, তেমন মানবজাতির ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয় বিষয় হলো শান্তি। তিনি মনে করতেন এই শান্তির মাধ্যমে সমস্ত দেশগুলির মধ্যে আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে এবং তিনি আরো বলেন শান্তি হল এমন একটি মূল্যবান সম্পদ, যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনাগুলি থেকে বলা যায় কান্ট এর চিরস্থায়ী শান্তি (Perpetual Peace) প্রতিষ্ঠার জন্য তিনটি মূল শর্তের প্রয়োজন। প্রথমত প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান দ্বিতীয়ত জাতিসংঘের একটি ফেডারেল কাঠামো এবং তৃতীয়ত আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিষ্ঠা। তিনি এই তিনের মাধ্যমে চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে মনে করতেন।
তথ্যসূত্র (References)
- Radhakrishnan, S.1919. The Philosophy of Rabindranath Tagore. London Macmillian and Co.
- Conflict Resolution and Gandhian Ethics –Thomas Weber, Gandhi Peace Foundation, New Delhi, 1991.
- Peace Education: The Concept, Principles and Practices around the World – (eds.) Gabriel Solomon and Baruch Nevo, .
- Comprehensive Peace Education—Betty Reardon, Teachers College Press, 1988.
- Philosophical Perspectives of Peace – Howard P. Kainz
- Peace, War and Defence – (ed.) Johan Galtung
- Perpetual Peace a philosophical essay-Immanuel kant
- Internet Sources
প্রশ্ন – ইমানুয়েল কান্ট এর লেখা একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম লেখ।
উত্তর – ‘Critique of Pure Reason’ হল ইমানুয়েল কান্ট এর লেখা একটি বিখ্যাত গ্রন্থ।
প্রশ্ন – কান্টের মতে চিরস্থায়ী শান্তির মূল নীতি কি?
উত্তর – কান্টের মতে চিরস্থায়ী শান্তির মূল নীতি হল – প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান, জাতিসংঘের একটি ফেডারেল কাঠামো এবং আন্তর্জাতিক আইন প্রতিষ্ঠা।
প্রশ্ন – কান্টের মতবাদের নাম কী?
উত্তর – কান্টের একটি মতবাদের নাম হল বিচার তত্ত্ব (“Transcendental Analytic”)।
- চিরস্থায়ী শান্তি সংক্রান্ত কান্টের মতবাদ | Kant’s Doctrine of Perpetual Peace
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবতাবাদ ব্যাখ্যা কর | Discuss the Tagore Humanism
- মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো | Features of Mahatma Gandhi’s Non-Violence Policy
- কান্টের নৈতিকতা ও শান্তির মধ্যে সম্পর্ক | Kant’s Relationship Between Morality and Peace
- ব্যাপ্তি কাকে বলে | ব্যাপ্তি কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় | What is Vyapti