দর্শন কি | দর্শন কাকে বলে | What is Philosophy

বৈচিত্রময় বিশ্বকে জানার কৌতূহল মানুষের চিরকালের।ঠিক যেমন কৌতুহলবশত মানুষ জানতে চায় দর্শন কি (What is Philosophy)? এই কৌতূহল, আগ্রহ ও বিস্ময় থেকেই জন্ম নিয়েছে যে শাস্ত্র তার নাম দর্শন।

মানুষের মধ্যে রয়েছে জানার অনন্ত আগ্রহ, জানার পিপাসা চিরন্তন। মানুষ যা কিছু দেখে বা জানে সে সম্পর্কে নানান প্রশ্ন সৃষ্টি হয় তার মনে। কোথা থেকে? কবে? কিভাবে? এবং কেন? এইসব প্রশ্ন সব সময় মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। মানুষ প্রতিনিয়ত এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। যতক্ষণ না পর্যন্ত সে সঠিক উত্তরের মুখোমুখি হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তার কৌতুহল সমাপ্তি ঘটে না।

দর্শন শব্দের অর্থ কি | Meaning of Philosophy

দর্শন শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Philosophy। এই Philosophy শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ ‘Philos’ এবং ‘Sophia’ থেকে উদ্ভুত।‘Philos’ শব্দের অর্থ হল অনুরাগ এবং ‘Sophia’ শব্দটির অর্থ জ্ঞান (Knowledge)।তাই দর্শন (Philosophy) শব্দের অর্থ হল জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা ভালোবাসা।   

দর্শন শব্দের অর্থ শব্দটির প্রতিশব্দ রূপে দর্শন শব্দটি ব্যবহার হয় কিন্তু শব্দ দুটির অর্থ এক নয় ব্যুৎপত্তির দিক থেকে ফিলোসফি শব্দের অর্থ জ্ঞানের প্রতি অনুরোধ আর দর্শন শব্দের অর্থ সত্য দর্শন বা তথ্য দর্শন সুতরাং আক্ষরিকভাবে বলা যায়, যার  জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা ভালোবাসা আছে তিনি হলেন দার্শনিক (Philosopher).

দর্শন শব্দটি আবার দৃশ্‌ ধাতু থেকে  উৎপত্তি। দর্শন শব্দের সাধারণ অর্থ হল দেখা। তবে দার্শনিকরা দর্শন শব্দটিকে ঠিক সাধারণ অর্থে গ্রহণ করেননি, কারণ সাধারণ অর্থে দেখাই দর্শন নয়। সত্য বা সত্যের স্বরূপ উপলব্ধি করাই হল দর্শন।

দর্শন কাকে বলে | Definition of Philosophy

দর্শন কি (What is Philosophy) এবং কাকে বলে এই প্রশ্নের উত্তর পেলেই দর্শনের স্বরূপ ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কিন্তু এই প্রশ্নের কোন স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট উত্তর আজও মেলেনি। নানা দেশে বিভিন্ন মনীষী দর্শনের সংজ্ঞা নানাভাবে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ফলে দর্শনের সর্বজন স্বীকৃত সংজ্ঞা আজও তৈরি হয়ে ওঠেনি। আর দর্শনে নির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকায় দর্শনের স্বরূপ তাই নির্দিষ্ট হতে পারেনি।

দর্শনের উৎপত্তি নিয়েও দার্শনিকদের মধ্যে নানারকম মতভেদ রয়েছে।প্লেটো বলেন – বিস্ময়ই দর্শনের উৎস (Philosophy begins in wonder)। দার্শনিক রেনে দেকার্ত এর মতে সংশয় হল দার্শনিক চিন্তার উৎস (Philosophy begins in doubt)। সক্রেটিস মনে করেন জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ থেকেই দর্শনের উৎপত্তি। আবার কোন কোন দার্শনিক মনে করেন, জ্ঞান-প্রীতি দার্শনিক চিন্তার উৎস।

তবে দর্শন কাকে বলে, তার একটি যথাযথ সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব না হলেও বিভিন্ন দার্শনিকের দেওয়া বিভিন্ন সংজ্ঞা গুলিকে উপস্থাপিত করা হল –

দার্শনিক প্লেটোর মতে – বস্তুর মূলস্বরূপ এর বিশুদ্ধ সত্তার, যা অস্তিত্বশীল তার জ্ঞান হল দর্শন। অর্থাৎ দর্শন হল অপরিবর্তনীয় ও শাশ্বত সত্তার জ্ঞান।

অ্যারিস্টটলের মতে – দর্শন হলো বস্তুর স্বরূপ এবং স্বরূপগত গুণের বিশ্লেষণকারী বিজ্ঞান।তিনি দর্শনকে বিশুদ্ধ সত্তার মূল স্বরূপের জ্ঞান বলে চিহ্নিত করেছেন।

হারবার্ট স্পেনসারের মতে – বিজ্ঞান হল আবশ্যিকভাবে ঐক্যবদ্ধ জ্ঞান। দর্শনের সামান্যীকরণ গুলি বিজ্ঞানের ব্যাপকতম সামান্যীকরণ উপলব্ধি করে এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ করে।

কান্টের মতে – দর্শন হলো জ্ঞান সম্পর্কিত বিজ্ঞান এবং তার সমালোচনা।

পেরির মতে – দর্শন আকস্মিক নয় অলৌকিক নয় বরং অনিবার্য ও স্বাভাবিক।

কোঁতের মতে – দর্শন হল সকল বিজ্ঞানের বিজ্ঞান।

পলসনের মতে – দর্শন হল সকল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সমষ্টি।

ফিক্ টের মতে – দর্শন হল জ্ঞান সম্পর্কিত বিজ্ঞান।

ব্রাডলের মতে – বস্তুর অভ্যাস নয় বস্তু স্বরূপের জ্ঞানী হলো দর্শন।

ওয়েবারের মতে – দর্শন হলো প্রকৃত বিষয়ে সামগ্রিক দৃষ্টি লাভের অনুসন্ধান, যা বস্তুর সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা।

মারভিনের মতে – দর্শন হল সত্যের প্রতি অনুরাগ এমন এক জ্ঞানের পূর্ণ ভান্ডার সমস্ত সত্য যার অন্তর্ভুক্ত। যার মধ্যে সমস্ত সত্য এক মহান অখণ্ড তার মধ্যে সুবিন্যস্ত।

যে সত্য বা তত্ত্ব সমগ্র বিশ্বে নিহিত। যা থেকে এই বিশ্বের চেতন, অচেতন সকল কিছুই উদ্ভূত। ভারতীয় দার্শনিক সেই পরম সত্যকে দেখতে চান, উপলব্ধি করতে চান, জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে চান।

তবে পাশ্চাত্যের ফিলোসফি সঙ্গে ভারতীয় দর্শনের প্রধান পার্থক্য হল- পাশ্চাত্যে, ফিলোসফি চর্চার মূল লক্ষ্য জ্ঞানকে চরিতার্থ করা। সেখানে মননের সঙ্গে আচরণের সম্বন্ধ সাধনের প্রচেষ্টা নেই। কিন্তু ভারতীয় দর্শনের লক্ষ্য নিছক সত্যচর্চা নয়, সত্য চর্যাও তাতে যুক্ত হয়েছে। সত্য জ্ঞানের আলোকে আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করা, বিচারের সঙ্গে আচারের সমন্বয় সাধন করাই ভারতীয় দর্শনের লক্ষ্য।

ভারতীয় দর্শন আধ্যাত্মিকতাবাদের দর্শন। একমাত্র চার্বাক দর্শন ছাড়া অপর সকল দর্শন গভীরভাবে আধ্যাত্মিক।এই আধ্যাত্মিকতাবাদী মতবাদ জড়বাদের বিরোধী মতবাদ। জড়বাদ অনুসারে জড়বস্তুই পরমতত্ত্ব। আর আধ্যাত্মিকতাবাদ অনুসারে অজড় আত্মাই পরমতত্ত্ব। এই পরমতত্ত্ব আত্মাকে জীবনে উপলব্ধি করাই হলো পরম লক্ষ্য। ভারতীয় দার্শনিকরা যাকে মোক্ষ বা মুক্তি বলেছেন। অবিদ্যা জীবনে দুঃখের মূল কারণ। অবিদ্যা বিনাশ হলে দুঃখ মুক্তি হয়। তত্ত্বজ্ঞানে অবিদ্যা নাশ হয় ও দুঃখ মুক্তি লাভ হয়।এই দুঃখ মুক্তি হল মানব জীবনের পরম পুরুষার্থ।মোক্ষ লাভ হলে মানুষের জীবনে আর কিছুই কামনা করার থাকে না। তাই মোক্ষ হল পরমপ্রাপ্তি বা পরম পুরুষার্থ।  ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষ এই চারটি মানুষের জীবনে কাম্য বস্তু বা পুরুষার্থ। ধর্ম, অর্থ, কাম মানুষের জীবনের কাম্য বস্তু হলেও জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য হল মোক্ষ লাভ।

আরোও পড়ুন – Click here

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায় জীবন ও জগৎ যেহেতু অনন্ত বৈচিত্র্যে ভরা এবং জ্ঞানের অন্বেষণ যখন অনন্ত অর্থাৎ যার কোন শেষ নেই, তখন দর্শনেরও কোনো বিশেষ পরিসীমা হতে পারে না। তাই সমস্ত কিছু আলোচনা করেও প্রশ্ন থেকেই যায় যে দর্শন কি (What is Philosophy)? বা দর্শন কাকে বলে? কারণ নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়ে উঠতে অক্ষম।

তথ্যসূত্র (References)

  • History of Western Philosophy: B. Russell
  •  History of Modern Philosophy: R. Falckenberg
  •  A History of Philosophy: F. Thilly
  •  A History of Modern Philosophy: W.K. Wright
  • Internet Sources

প্রশ্ন – দর্শন কত প্রকার ও কি কি?

উত্তর – দর্শনের মূলত তিনটি শাখা ১) অধিবিদ্যা (Metaphysics) ২) জ্ঞানতত্ত্ব বা জ্ঞানবিদ্যা (Epistemology) ৩) মূল্যবিদ্যা (Axiology)। এই মূল্যটা আবার তিনটি শাখা রয়েছে ৪) যুক্তিবিদ্যা () ৫) ও নীতিবিদ্যা (Ethics) ও ৬) সমাজবিদ্যা (Social Philosophy)।

প্রশ্ন – দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কে?

উত্তর – দার্শনিক থেলিস হলেন দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা।

প্রশ্ন – ভারতীয় দর্শনের জনক কে?

উত্তর – শঙ্করাচার্যকে ভারতীয় দর্শনের জনক বলা হয়।

প্রশ্ন – দার্শনিক কাদের বলা হয়?

উত্তর – যিনি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎ ও জীবনের যুক্তিগ্রাহ্য ও বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং জাগতিক বিষয় ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করেন তিনি দার্শনিক।

প্রশ্ন -দর্শন শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন কে

উত্তর –দার্শনিক পিথাগোরাস প্রথম এই দর্শন নামক শব্দটির ব্যবহার করেন।

প্রশ্ন – পাশ্চাত্য দর্শনের জনক কাকে বলা হয়?

উত্তর – সক্রেটিস কে পাশ্চাত্য দর্শনের জনক বলা হয়।

প্রশ্ন – আধুনিক দর্শনের জনক কাকে বলা হয়?

উত্তর – রেনে ডেকার্ট কে আধুনিক দর্শনের জনক বলা হয়।

প্রশ্ন – বিখ্যাত কয়েকটি দার্শনিকের নাম লেখ।

উত্তর – কয়েকটি বিখ্যাত দার্শনিক হলেন সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল প্রমূখ।

প্রশ্ন – দর্শন শুরু কোথা থেকে?

উত্তর – মানুষের মনের মধ্যে নানান কৌতূহল, বিস্ময় ইত্যাদির মাধ্যমে নানান প্রশ্নের উত্তর খোঁজার বা জানার ইচ্ছা থেকেই দর্শনের শুরু।

প্রশ্ন – দর্শনের উদ্দেশ্য কি?

উত্তর – দর্শনের উদ্দেশ্য হল এই জগৎ ও জীবনকে জানা ও চেনা এবং নানান রকম সমস্যা এবং তাদের সমাধানের উত্তর খুঁজে বের করা অর্থাৎ সঠিক পথ প্রদর্শন করাই হল দর্শনের উদ্দেশ্য।

Leave a Comment