বাচনিক জ্ঞান যেহেতু জ্ঞানের একটি প্রকার, সেহেতু বাচনিক জ্ঞানকে জানতে হলে বাচনিক জ্ঞানের আবশ্যিক ও পর্যাপ্ত শর্ত (Necessary and Sufficient Conditions of Verbal Knowledge) কি তা জানা প্রয়োজন।
জ্ঞানতত্ত্বের প্রধান আলোচ্য বিষয় হল জ্ঞান। কোন কিছুর বা কোন বিষয়ের জ্ঞান হতে গেলে তার যে শর্তগুলি প্রযোজ্য সেগুলি তার ক্ষেত্রে আবশ্যিক ও পর্যাপ্ত শর্ত (Necessary and Sufficient Conditions)।
বাচনিক জ্ঞানের আবশ্যিক ও পর্যাপ্ত শর্ত | Necessary and Sufficient Conditions of Verbal Knowledge
‘জ্ঞান’ (Knowledge) শব্দটিকে আমরা ‘জানা’ (to know) অর্থে ব্যবহার করে থাকি। ‘জ্ঞান’ অর্থাৎ কোন কিছুর জ্ঞান রয়েছে বলতে আমরা কোন কিছুকে জানি, এমনটাই বলতে পারি। সুতরাং জ্ঞান হল কোন কিছু জানা। অর্থাৎ কোন কিছু সম্পর্কে জানি বলে আমরা দাবি করি।
‘জ্ঞান’ বা ‘জানা’ শব্দটি বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যবহার করি। জ্ঞান শব্দটা কখনো পরিচিতি অর্থে, কখনো আবার দক্ষতা বা সামর্থ অর্থে, আবার কখনো বাচনিক অর্থেও ব্যবহার করি।
জ্ঞানতত্ত্বের একটি মুখ্য প্রশ্ন হল কোন অবস্থায় বা কখন বলা যাবে যে, আমার কোন বিষয়ে জ্ঞান হয়েছে। যদি এভাবে বলা হয় বাচনিক জ্ঞানের আবশ্যিক ও পর্যাপ্ত শর্ত (Necessary and Sufficient Conditions of Verbal Knowledge) কি?
তাহলে এমনটাই বলতে হবে R যদি কোন বচন হয় এবং S কোন ব্যক্তি হয় তাহলে কোন অবস্থায় এবং কোন শর্ত পূরণ করলে S ব্যক্তি বলতে পারবে যে ‘আমি R কে জেনেছি’ বা R কে জানি।
দার্শনিক Ayer কে অনুসরণ করে অধ্যাপক হসপার্স বাচনিক জ্ঞানের প্রধান তিনটি শর্তের কথা বলেছেন। আমরা সে শর্তগুলি নিম্নলিখিত ভাবে আলোচনা করব –
সত্যতার শর্ত
প্রথম শর্ত হল সত্যতার শর্ত। বচনটিকে সত্য হতে হবে অর্থাৎ ‘R’ কে সত্য হতে হবে।
‘জানা’ শব্দের অর্থের মধ্যেই এই শর্তটি নিহিত আছে যে R কে জানা এর মানে হল R এর সত্য হওয়া। যদি R সত্য না হয়, তাহলে ‘R কে জেনেছি’ এমনটা আমরা বলতে পারব না।
‘আমার পড়ার ঘরে একটা আলমারি আছে’, এই বচনটি সত্য না হলে অর্থাৎ আমার পড়ার ঘরে বাস্তবিক কোন আলমারি না থাকলে, বলা যাবে না বা এমন বলতে পারব না ‘আমি জানি যে আমার পড়ার ঘরে একটা আলমারি আছে’।
‘আমি R কে জানি কিন্তু R সত্য নয়’ এমন বললে স্ববিরোধী হবে। আমার কোন কিছু জানার আবশ্যিক শর্ত হল (Necessary Condition) জানার বিষয়ে যে বচন তাকে সত্য হতে হবে। অবশ্য এমন হতে পারে না পারে যে, আমি ভেবেছিলাম যে আমি জেনেছি এবং সে ক্ষেত্রে আমার ভাবনার বিষয় R সত্য নয়, মিথ্যা। এমন ক্ষেত্রে কোন স্ববিরোধীতা হয় না।
জানার এই প্রকার শর্তকে বিষয়গত শর্ত বলা হয়। জানার ক্রিয়াটি যে নিছক মনোগত ব্যাপার নয়, জানা যে তার বিষয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় শর্ত টির দ্বারা এরূপ প্রতিপন্ন হয়।
সুতরাং সত্যতার শর্ত হল বাচনিক জ্ঞানের একটি আবশ্যিক ও পর্যাপ্ত শর্ত (Necessary and Sufficient Conditions of Verbal Knowledge)।
বিশ্বাসের শর্ত
দ্বিতীয় শর্ত হল বিশ্বাসের শর্ত। বচনটি কেবল সত্য হলেই হবে না, বচনটির প্রতি বিশ্বাসও থাকতে হবে। অর্থাৎ R কে সত্য হলেই হবে না, R – এর প্রতি বিশ্বাস থাকতে হবে।
আমি যে বচনটিকে ‘জানি’ বলে দাবি করছি, সেই বচনটি কেবল সত্য হলেই চলবে না, সেই বচনটির সত্যতা সম্পর্কে আমার বিশ্বাসও থাকতে হবে। R এর প্রতি বিশ্বাসের মনোভাব না থাকলে, ‘আমি R কে জানি’ এমনটা বলতে পারব না। জানার মধ্যেই বিশ্বাসের শর্তটি নিহিত থাকে।
S ব্যক্তির ক্ষেত্রে শুধু R কে জানলেই হবে না, সে বিষয়ে বিশ্বাস থাকতে হবে। যদি কেউ বলে ‘আমি R কে জানি সত্য’ কিন্তু ‘আমি বিশ্বাস করি না যে R সত্য’ তাহলে এটাই বুঝতে হবে যে কোন বিশেষ অবস্থায় ‘জানা’ শব্দটিকে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা সে জানেনা।
কাজেই বিশ্বাসের শর্তটিও সত্যতার শর্তের মতো জানার একটি আবশ্যিক শর্ত।সত্যতার শর্তটি যেমন জ্ঞানের বিষয়গত শর্ত, বিশ্বাসের শর্তটি তেমনই জ্ঞানের বিষয়ীগত শর্ত।
ধরা যাক যদি কেউ এমনটা বলে যে, ‘মিথ্যে কথা বলা মহাপাপ’ তাহলে যে জ্ঞানের বিষয় সেটি সত্য হলেই হবে না। সে ক্ষেত্রে বিষয়টির প্রতি বিশ্বাসও থাকা আবশ্যক। আবার কেউ যদি বলে আমি জানি ও বিশ্বাস করি যে ‘মিথ্যে কথা বলা মহাপাপ’, সেক্ষেত্রে তার বিশ্বাসটি নেহাৎই আন্দাজ বা অন্ধবিশ্বাস।
কাজেই জ্ঞান হতে গেলে সত্যতার শর্ত ও বিশ্বাসের শর্ত এই দুটি শর্ত থাকলেই হবে না সাথে সাথে অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তের উপর নির্ভর করতে হয়, তা হল তৃতীয় শর্ত।
এর থেকে বলা যায় দ্বিতীয় শর্ত হিসেবে বিশ্বাসের শর্তটিও বাচনিক জ্ঞানের আবশ্যিক ও পর্যাপ্ত শর্ত (Necessary and Sufficient Conditions of Verbal Knowledge)।
বিশ্বাসের সমর্থনে তথ্য, যুক্তি ও সাক্ষ্য-প্রমাণ
তৃতীয় শর্তটি হল বিশ্বাসের সমর্থনে তথ্য, যুক্তি ও সাক্ষ্য-প্রমাণ।
‘জ্ঞান’ (Knowledge) বা ‘জানা’ (to know), এই যে জানার বিষয় বচন তাকে গ্রহণ করার ব্যাপারে তথ্য, যুক্তি এবং উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকা ও প্রয়োজন।
‘বুধ গ্রহে জলের অস্তিত্ব আছে’ এমন উক্তি করার সময় আমি আমার ওই বিশ্বাসের সমর্থনে প্রয়োজনীয় তথ্য বা যুক্তি, আর সেই বিশ্বাসের সমর্থনে উপযুক্ত প্রমাণ দিতে সমর্থন না হওয়ায় বচনটি ‘জ্ঞান’ পদবাচ্য নয়।
যদি S ব্যক্তি জানে যে R, তাহলে R তে বিশ্বাস করার ব্যাপারে S যুক্তিযুক্ত হবে। তবে বিশ্বাসের সমর্থনে কি পরিমাণ যুক্তি, সাক্ষ্য এবং প্রমাণাদি থাকলে তা জ্ঞান হবে। বিশ্বাসের সমর্থনে কি পরিমান যুক্তি, তথ্য, প্রমাণ ইত্যাদিকে পর্যাপ্ত বলা যাবে এখানে তা নিয়ে সঙ্গত ভাবে প্রশ্ন দেখা দেয়।
অর্থাৎ তৃতীয় শর্ত থেকে এরূপ বলা যায় যে বিশ্বাসের সমর্থনে তথ্য, যুক্তি ও সাক্ষ্য-প্রমাণ হল বাচনিক জ্ঞানের আরো একটি আবশ্যিক ও পর্যাপ্ত শর্ত (Necessary and Sufficient Conditions of Verbal Knowledge)।
উপরোক্ত শর্তগুলি থেকে আমরা এমন বলতে পারি, ‘জানা’ বলতে আমরা বুঝি –
১. জানার বিষয় যে বচন তাকে সত্য হতে হবে।
২. বচনটির সত্যতা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস থাকতে হবে।
৩. বিশ্বাসের সমর্থনে যুক্তি ও সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকতেই হবে।
বাচনিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে উক্ত তিনটি শর্ত আলাদা আলাদা ভাবে জ্ঞানের আবশ্যিক শর্ত (Necessary Conditions of Verbal Knowledge) এবং এই তিনটি শর্ত একত্রে জ্ঞানের পর্যাপ্ত শর্ত (Sufficient Conditions of Verbal Knowledge)।
উপসংহার
পরিশেষে আমরা এটাই বলতে পারি যে পৃথক পৃথক ভাবে তিনটি শর্তের কোন একটির দ্বারা বাচনিক জ্ঞান পরিপূর্ণ হতে পারে না। সেহেতু বাচনিক জ্ঞান তখনই পরিপূর্ণ হবে যখন উপরিউক্ত তিনটি শর্ত একই সাথে মান্যতা পাবে এবং সেগুলি হবে বাচনিক জ্ঞানের আবশ্যিক ও পর্যাপ্ত শর্ত (Necessary and Sufficient Conditions of Verbal Knowledge)।
তথ্যসূত্র (References)
- The Fundamental Questions of Philosophy: A. C Ewing
- The Fundamentals of Philosophy: D. L. Das
- Problems of Philosophy: G Watts Cunnigham
- An Introduction to Philosophical Analysis: John Hospers
- Internet Sources
প্রশ্ন – আবশ্যিক শর্ত কাকে বলে?
উত্তর – আবশ্যিক শর্ত হল কারনের সেই অর্থ যেখানে প্রথম ঘটনাটি না ঘটলে দ্বিতীয়টি ঘটবে না আবার প্রথমটি ঘটলে দ্বিতীয়টি নাও ঘটতে পারে।
প্রশ্ন – পর্যাপ্ত শর্ত কাকে বলে?
উত্তর – পর্যাপ্ত শর্ত বলতে বোঝায় সেই সমস্ত শর্তগুলি যেগুলির প্রথম ঘটনাটি ঘটলে দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটবে। আবার প্রথম ঘটনাটি না ঘটলেও দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটতে পারে।
প্রশ্ন – আবশ্যিক শর্তের উদাহরণ।
উত্তর – আবশ্যিক শর্তের একটি উদাহরণ হল- অক্সিজেন হল দহনের কারণ।
প্রশ্ন – পর্যাপ্ত শর্তের উদাহরণ।
উত্তর – পর্যাপ্ত শর্তের উদাহরণ হল- বৃষ্টি হল মাটি ভেজার কারণ।
প্রশ্ন – আবশ্যিক পর্যাপ্ত শর্তের উদাহরণ দাও।
উত্তর – আবশ্যিক পর্যাপ্ত শর্তের একটি উদাহরণ হল – ভিজে কাঠে অগ্নিসংযোগ না করলে ধুম উৎপন্ন হবে না এবং ভিজে কাঠের অগ্নিসংযোগ করলে ধুম উৎপন্ন হবে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবতাবাদ | Discuss the Tagore Humanism
- মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো | Features of Mahatma Gandhi’s Non-Violence Policy
- কান্টের নৈতিকতা ও শান্তির মধ্যে সম্পর্ক | Kant’s Relationship Between Morality and Peace
- ব্যাপ্তি কাকে বলে | ব্যাপ্তি কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় | What is Vyapti
- দর্শনের স্বরূপ আলোচনা করো | The Nature of Philosophy